বুকে ব্যথার ঘরোয়া সমাধান ও প্রতিকার , Chest Pain Home Remedies ..!
কখনো যদি কারোর হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়, হার্ট অ্যাটাকের আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরে।
...কখনো কখনো বুকে ব্যথা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ঠিকই কিন্তু তা বলে সব ক্ষেত্রেই বুকে ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস নয় অর্থাৎ বুকে ব্যথা হলেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে এমনটা নয়। বুকে ব্যথার আরও অন্যান্য কারণও থাকতে পারে। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে কী কী কারণে বুকে ব্যথা হয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে এই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন। এখানে এমন কিছু ঘরোয়া সমাধান দেওয়া হয়েছে যে গুলো বুকে ব্যথা কমাতে অনেকটাই সাহায্য করে। কিন্তু বুকে ব্যথা যদি গুরুতর হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।
বুকে ব্যথার কারণ
আসুন আমরা প্রথমেই জেনে নিই বুকে ব্যথার কারণগুলো কী কী? আসলে প্রত্যেক ব্যক্তির বুকে ব্যথার কারণ আলাদা আলাদা হয়। কারো বুকের বাম দিকে ব্যথা করে, তো কারো আবার বুকের ডান দিকে। এছাড়া কারোর আবার বেশি সময়ের জন্য ব্যথা হয়, কারোর কম সময়ের জন্য। কারোর ব্যথা তীব্র হয়, কারোর মৃদু। বুকে ব্যথার আসল কারণ শুরুতেই বলা সম্ভব নয়। এর জন্য ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে জরুরী। দেখি কী কী কারণে বুকে ব্যথা হয়?
হার্ট জনিত কারণ :
ফুসফুস জনিত কারণ :
পেশী ও হাড় জনিত কারণ :
পরিপাক তন্ত্র জনিত কারণ :
অন্যান্য কারণ :
বুকে ব্যথার কারণগুলো জেনে নেওয়ার পর বুকে ব্যথার লক্ষণ বা উপসর্গ গুলো জেনে নেওয়া যাক।
বুকে ব্যথার উপসর্গ
বুকে ব্যথার সেভাবে কোনো উপসর্গ হয় না, কারণ বুকে ব্যথা কোনো অসুখ না। বুকে ব্যথার চিকিৎসা করতে হলে বুকে ব্যথার কারণগুলোর চিকিৎসা করতে হবে।
হৃৎপিণ্ড জনিত উপসর্গ
অন্যান্য উপসর্গ
বুকে ব্যথা শুধু কষ্ট দেয় না, জীবনযাত্রায় ব্যাঘাতও ঘটায়। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে কিছু ঘরোয়া উপায় দেওয়া হল। আশা করি এইগুলো নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে উপকার পাবেন।
ঘরোয়া উপায়ে বুকে ব্যথার সমাধান
উপায় ১ : রসুন
কী কী লাগবে?
১. এক চামচ রসুনের রস
২. এক কাপ ঈষদুষ্ণ জল
কী করতে হবে?
১. এক চামচ রসুনের রসের সাথে এক কাপ ঈষদুষ্ণ জল মেশানো হল।
২. ভালো করে মিশিয়ে এই মিশ্রণটি রোজ সেবন করুন। প্রতিদিন এক থেকে দুইবার এটি খেতে হবে।
৩. আপনি রোজ সকালে দুই কোয়া রসুনও খেতে পারেন।
কীভাবে কাজ করে?
রসুনের অনেক গুণাগুণের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি গুণ হল এটি হৃদরোগের সম্ভাবনা কমায় এবং হৃদপিণ্ডের রক্ত চলাচল বাড়ায়। হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল কম হলে হৃদরোগের সম্ভাবনা থাকে। যার ফলে বুকে ব্যথা শুরু হয়। রসুন উচ্চ রক্তচাপকেও নিয়ন্ত্রিত রাখে। তাই দৈনিক রসুন সেবন বুকে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে একটি খুব ভালো ঘরোয়া উপায়।
উপায় ২ : ভিটামিন
গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে যে ভিটামিন ডি আর ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অভাবে বুকে ব্যথা হয়, এমনকি মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। (3) তাই যদি আপনি বুকে ব্যথার জন্য ভোগেন, তাহলে প্রথমেই আপনাকে আপনার ডায়েটের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আপনার ডায়েট চার্টে যেন ভিটামিন, মিনারেল ও অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর খাবার থাকে যা খেলে আপনি হবেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। দেহের জন্য ব্যালেন্সড ডায়েট খুব প্রয়োজন। মাছ, মাংস, ডিমের কুসম, সিরিয়াল, সয়াবিন, দুধ, চিজ ইত্যাদি অবশ্যই খেতে হবে। ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে এই ভিটামিন গুলো নিতে অতিরিক্ত সাপ্লিমেন্টও সেবন করতে পারেন।
উপায় ৩ : হলুদ দুধ
কী কী লাগবে?
১. হাফ চামচ হলুদ গুঁড়ো
২. এক গ্লাস গরম দুধ
কী করতে হবে?
এক গ্লাস গরম দুধে হাফ চামচ হলুদ গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে খান। এই মিশ্রণটি রোজ একবার করে খেতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে এটি সেবন করলে খুব উপকার পাবেন।
উপায় ৪ : তুলসী পাতা
কী কী লাগবে?
১. আট থেকে নয়টি তুলসী পাতা
কী করতে হবে?
১. তুলসী পাতা চিবিয়ে খান।
২. তুলসী পাতা দিয়ে চা বানিয়ে পান করতে পারেন।
৩. এক চামচ তুলসী পাতার রস বানিয়ে মধু মিশিয়ে খান।
উপকার পেতে প্রত্যেকদিন তুলসী পাতা সেবন করুন।
কীভাবে কাজ করে?
তুলসী পাতায় থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে এবং ম্যাগনেসিয়াম। ম্যাগনেসিয়াম হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে এবং রক্তজালকগুলোকে আরাম প্রদান করে। (5) এই কারণেই হার্টের অসুখের চিকিৎসায় ও বুকে ব্যথার জন্য তুলসী পাতা খুব উপকারী।
উপায় ৫ : লালমরিচ
কী কী লাগবে?
১. এক চা চামচ লাল মরিচ পাউডার
২. এক গ্লাস যে কোনো ফলের রস
কী করতে হবে?
১. এক গ্লাস ফলের রসের সাথে এক চা চামচ লাল মরিচ পাউডার যোগ করুন।
২. ভালো করে মিশিয়ে পান করুন। রোজ একবার করে এটি সেবন করুন।
উপায় ৬ : মেথি
কী কী লাগবে?
১. এক চা চামচ মেথি বীজ
কী করতে হবে?
১. রাত্রিবেলা এক কাপ জলে মেথি বীজ ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন সকালে একটা ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ওই মেথি ভেজা জল খান।
২. এছাড়া আরেকটি উপায় রয়েছে। একটি পাত্রে জল নিয়ে মেথি বীজ গুলো দিন। ৫ মিনিট ফুটিয়ে নিন। ঠাণ্ডা করে নেওয়ার পর ছেঁকে নিয়ে সেই জল সেবন করুন। দিনে এক থেকে দুইবার সেবন করুন।
কীভাবে কাজ করে?
মেথি বীজে রয়েছে প্রদাহনাশক গুণ। এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ধর্মও রয়েছে। যার জন্য বুকে ব্যথা কমাতে মেথি বীজ খুব সহায়ক। (1)কোলেস্টরেলের মাত্রা কমিয়ে এবং হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতিও করে মেথি।
উপায় ৭ : আমন্ড
কী কী লাগবে?
একমুঠো আমন্ড বা কাঠবাদাম।
কী করতে হবে?
১. একমুঠো কাঠবাদাম কয়েক ঘন্টার জন্য একটা পাত্রে জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
২. এরপর কাঠবাদামের খোসা ছাড়িয়ে খেতে হবে।
৩. আপনি চাইলে আমন্ড অয়েল এবং গোলাপের এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে বুকে মালিশ করতে পারেন। এটি রোজ একবার করে করতে হবে।
কেন এটি কার্যকরী?
কাঠবাদাম বহু অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডে ভরপুর, যা শুধু হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্যপই ভালো নয়, তার সাথে সাথে এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও সাহায্য করে। (8)
এর কারণে এটি হৃদরোগের রোগীদের জন্য এবং বুকে ব্যথার চিকিৎসায় সহায়ক।
বুকে ব্যথার চিকিৎসা
যেমন বুকে ব্যথার কারণ আলাদা আলাদা হয়, তেমনই এর চিকিৎসাও আলাদা আলাদা।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
নিম্নলিখিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার দেখান। (9)
বুকে ব্যথা থেকে বাঁচতে যোগ ব্যায়াম
এবার জানবেন বুকে ব্যথা থেকে বাঁচতে যোগ ব্যায়াম কতটা উপকারী। প্রতিদিন যোগ ব্যায়াম অভ্যাস করলে নিরোগ থাকা যায়। বুকে ব্যথা সহ বহু রোগের চিকিৎসায় যোগ ব্যায়াম খুব ভালো কাজ করে। জেনে নেওয়া যাক কোন কোন যোগাসন করলে আপনি বুকে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারেন?
সূর্য নমস্কার আসন
বুকে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সূর্য নমস্কার আসনের অভ্যাস করা লাভদায়ক। বলা হয় যে প্রতিদিন সূর্য নমস্কার আসন করলে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। (10) সূর্য নমস্কার আসনে মোট ১২ টি মুদ্রা থাকে যেগুলো ধাপে ধাপে করতে হয়, এই মুদ্রা গুলো হল – প্রণাম আসন, হস্ত উত্তানাসন, পাদহস্তাসন, অশ্ব সঞ্চালনাসন, পর্বতাসন, অষ্টাঙ্গাসন, ভুজঙ্গাসন, পর্বতাসন, অশ্ব সঞ্চালনাসন, হস্ত উত্তনাসন, প্রণাম আসন।
প্রণাম আসন
আপনার যোগাসন মাদুরের ওপর দাঁড়ান। দুই পা জোড়া করুন এবং আপনার দেহের ওজন দুপায়ের ওপর সমান ভাবে রাখুন। বুকের ছাতি প্রসারিত করুন এবং দুই কাঁধ শিথিল করুন। শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে দুদিক থেকে হাত তুলুন এবং শ্বাস ছাড়ার সময় দুই হাত বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গি করুন।
হস্ত উত্তানাসন
এবার শ্বাস নিতে নিতে দুহাত ওপরে তুলে পিছন দিকে নিন। হাতের বাইসেপ্ যেন কানকে স্পর্শ করে থাকে। এই ভঙ্গিতে সমস্ত শরীরকে পায়ের গোড়ালি থেকে হাতের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত যথাসম্ভব স্ট্রেচিং করুন।
পাদহস্তাসন
শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মেরুদন্ড সোজা রেখে কোমর থেকে সামনের দিকে ঝুঁকুন; শ্বাস পুরোপুরি ছাড়া হলে মেঝেতে পায়ের দুপাশে দুই হাত রাখুন।
অশ্ব সঞ্চালনাসন
শ্বাস নিতে নিতে, ডান পা যতখানি সম্ভব পিছনের দিকে ঠেলুন; ডান হাঁটু মেঝের ওপর রাখুন এবং ওপরে তাকান। মাথায় রাখতে হবে বাঁ পা দুই হাতের তালুর ঠিক মাঝখানে যেন থাকে।
পর্বতাসন
শ্বাস নিন, বাঁ পা ডান পায়ের মত পিছনে নিয়ে শরীরকে এক সরল রেখায় আনুন।
অষ্টাঙ্গাসন
হাল্কা ভাবে দুই হাঁটু মেঝেতে রেখে শ্বাস ছাড়ুন। নিতম্ব সামান্য পিছনে নিন। সামনের দিকে শরীর আনুন, বুক এবং চিবুক মেঝেতে রাখুন। নিতম্ব সামান্য উপরে তুলুন। দেখতে হবে দুই হাত, দুই পা, দুই হাঁটু, বুক এবং চিবুক (দেহের আটটি অংশ) মেঝেতে স্পর্শ করেছে।
ভুজঙ্গাসন
বুক থেকে দেহের উপরিভাগ সাপের ভঙ্গিতে তুলুন। এই ভঙ্গিতে কনুই ভাঁজ করে রাখতে পারেন, দুই কাঁধ দুই কানের থেকে দূরে এবং দৃষ্টি উপরের দিকে থাকবে।
পর্বতাসন
শ্বাস ছাড়ার সময় নিতম্ব এবং টেলবোন ওপরে তুলুন, বুক নীচের দিকে ইংরাজী অক্ষর V –এর উল্টো ভঙ্গিতে থাকবে।
অশ্ব সঞ্চালনাসন
শ্বাস নিয়ে ডান পা সামনের দিকে এনে দুই হাতের মাঝখানে রাখুন, বাঁ হাটু মেঝেতে, নিতম্বকে নীচের দিকে চাপ দিন এবং দৃষ্টি রাখুন ওপরে।
পাদ হস্তাসন
শ্বাস ছেড়ে, বাঁ পা সামনে আনুন। হাতের তালু মেঝেতে রাখুন।
হস্ত উত্তানাসন
শ্বাস নিতে নিতে মেরুদন্ডকে ওপরে তুলুন, দুহাত উপরের দিকে তুলে সামান্য পিছন দিকে নিন, নিতম্ব হাল্কা ভাবে বাইরের দিকে ঠেলে রাখুন৷
প্রণাম আসন
যখন শ্বাস ছাড়ছেন প্রথমে শরীর সোজা করুন, তারপর দুই হাত নীচে আনুন। একদম শুরুর মুদ্রায় চলে আসুন এবং এই ভঙ্গিতে বিশ্রাম নিন।
ভুজঙ্গাসন
যদি শ্বাসজনিত কোনো সমস্যার জন্য বুকে ব্যথা হয়, তাহলে আরাম পেতে এই আসন অভ্যাস করতে পারেন। ভুজঙ্গ অর্থ সাপ, সাপের ফনার মতাে দেখতে লাগে বলে আসনটির নাম ভুজঙ্গাসন। দেখে নেওয়া যাক এই আসনের পদ্ধতি।
মার্জরী আসন
বুকে ব্যথা থেকে আরাম পেতে এই আসন করতে পারেন। বলা হয় যে হজম সংক্রান্ত কারণে বুকে ব্যথা হলে এই আসন তার উপশম করে। আসুন এই আসন কীভাবে করতে হয় তা জেনে নিই।
অন্যান্য টিপস্
ঘরোয়া উপায়, ব্যায়াম ছাড়াও বুকে ব্যথা থেকে বাঁচতে আর কী কী করলে উপকার পাবেন? জেনে নেওয়া যাক আরও কিছু টিপস্।
এই লেখা পড়ে বুকে ব্যথার কারণ ও লক্ষণ বুঝতে পেরেই গেছেন। এর সাথে বুকে ব্যথা হলে কী করতে হবে সেই সম্পর্কেও জানতে পারলেন। বুকে ব্যথার সমস্যাকে হালকাভাবে নেবেন না। যদি বুকে ব্যথা প্যানিক অ্যাটাক, গ্যাস অম্বল বা কস্টোকন্ড্রিটিস ইত্যাদির জন্য হয়ে থাকে, তাহলে সহজেই চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু মায়োকন্ড্রিয়াল ইনফার্কশনের মত মারাত্মক রোগের জন্য বুকে ব্যথা হলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এই ধরনের রোগের জন্য বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন। এই ঘরোয়া উপায় ও টিপস্ গুলো মেনে চলার পরও যদি আপনার বুকে ব্যথা হয়, তাহলে ঘরে না বসে থেকে ডাক্তার দেখানো একান্তই দরকার। বুকে ব্যথা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। আশা করি এই আর্টিকেল পড়ে আপনি অনেক উপকৃত হবেন।
No comments: