Breaking News
recent

নদী কারো নয়


ইতিহাসের দীর্ঘশ^াস অথবা দেয়ালের দেশ
হুসাইন হানিফ

প্রথমে বন্দনা করি,

যদি কেউ জীবনের সমস্ত জ্ঞান আর প্রজ্ঞা, অনুভব আর অভিজ্ঞতা ৬০ বছর ধরে বলবে বলবে করে বলে, সেই- জীবনের একদম শেষ ধাপে এসে- ৮০ বছরের প্রবীণ বয়সে,- তখন সেই কথা শোনার বা জানার ইচ্ছে আমাদের জাগে; শোনার বা জানার ইচ্ছে জাগে বক্তার কোন যোগ্যতা আর সার্থকতা, অর্জন আর সাফল্য, স্বীকৃতি আর পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা স্মরণ করা ছাড়াই; আর সেই বক্তা যদি ‘যেকেউ’ না হয়ে হয় একজন সৈয়দ শামসুল হক- যে কি না শিল্পের প্রতিটি শাখায়- গান কি কবিতায়, গল্প কি উপন্যাসে, নাটক কি সিনেমায়, প্রবন্ধ কি সমালোচনায়, চিত্রাংকন কি অনুবাদে- স্বচ্ছন্দ (বলা চলে দিগন্তদিশারী), লেখক-পাঠক-সমালোচক-বোদ্ধা-মহল সকল শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য, সব্যসাচী হিসেবে অভিধিত; এক ডজন পুরস্কার পকেটে ভরা যার; সেই তার কথা তখন না শুনে বা না জেনে উপায় থাকে না সচেতন পাঠক বা লেখকের, কিংবা যেকোন ব্যক্তির অথবা যেকোন শ্রেণির মানুষের।
অতএব আমরা পড়ি এবং আলোচনার জন্য মনোনিবেশ করি; কেননা, এটি এমনই এক রচনা, পড়ার জন্য যেমন আমরা উতলা হয়ে উঠি; তেমনি সেটি পড়ে ব্যগ্র হয়ে পড়ি তার রস ভাগাভাগি করার জন্য; এ এমন এক বই - যার স্পর্শ পেতে চাইবে যে কেউ, কাছাকাছি থাকতে চাইবে যেকোন পাঠক; আর এর সারবত্তাটিকে তুলে আনতে গেলেও অন্তত পক্ষে একটা বইয়ের আশ্রয় দরকার, কেননা, এর বিষয় আর বিস্তৃতি রীতিমতো ভয় ধরানো : সেটা আমরা ছেড়ে দিই তুখোড় সমালোচক আর সাহিত্যের অধ্যাপকদের জন্য; বয়সের স্বল্পতা কিংবা জ্ঞানের অপরিপক্বতার কারণে আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে উঠবে না হয়তো - অতএব ছোট একটি আলোচনা দিয়েই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হবে আমাদের। 

আমরা যা জানি তার আলোকে

একবাক্যে বলতে গেলে ‘নদী কারো নয়’ দেশভাগের ওপর লেখা একটি উপন্যাস; আরো ভালো করে বলতে গেলে দেশভাগের বিরোধিতার ওপর লেখা একটি উপন্যাস। দেশভাগের ফলে কী কী সমস্যার উদ্ভব হয়ে ছিল, হয়ে আছে, হতেই থাকবে, কাদের বজ্জাতির ফলে দেশটা ভাগ হল, কী করলে দেশটা ভাগ না হয়ে অখ- থেকে যেত; অথবা ভাগ যদি হবেই সেই ধর্মের ভিত্তিতে কেন, ভাষার ভিত্তিতে নয় কেন আর যেসব নেতাদের বদমায়েশির চূড়ান্ত রূপ: দেশভাগ;- তাদের গোমর আর গোপন থাকল কি না বা লাভের ভাগিদার কারা ছিল আর ক্ষতিটাই বা কাদের ভাগে পড়ল- এইসব ব্যাখ্যা করার জন্য, বস্তুত জীবন্ত করে দেখাবার জন্য সৈয়দ হক শিল্পের উল্লেখযোগ্য শাখা উপন্যাসের আশ্রয় নিয়েছেন।
‘নদী কারো নয়’- এই নামটার ভেতরেই স্পষ্টত বিরোধিতার আভাস। নদী কার? নদী কারো নয়! হিমালয় কার? হিমালয় কারো নয়। বস্তুত “ পৃথিবীতে এমন কিছু বিপুল বিরাট অনন্য বস্তু আছে যাকে নিশ্চয় কোনো দেশ দিয়ে বাঁধা যায় না। কোনো বিশেষ দেশের কোটরে ফেলে তাকে ছোটই করা হয়, তার মহিমাকে ক্ষুণœ করা হয়, তার আয়তনকে খর্ব করা হয়। ” তবে যে বলা হল কিংবা কোথায় থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এক শাদা চামড়ার র‌্যাডক্লিফ পেন্সিলের দাগ দিয়ে আধকোশাকে হিন্দুস্তানের করে দিল? তবে যে মহাত্মার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ধূর্ত গুজরাটি বানিয়া মোহনচাঁদ গান্ধির সম্মতিতে দেশটা ভাগ হয়ে গেল? সম্মতি যদি দিলই ধর্মের ভিত্তিতে কেন, ভাষার ভিত্তিতে নয় কেন; বাংলাকে অখ- রাখার জন্য শরৎ বসু, আবুল হাশিম আর সোহরাওয়ার্দির প্রচেষ্টাকে কেন খাটো করে দেখা হল; অহিংসাই যদি তার আসল কথা হয়ে থাকে তবে কেন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে রক্তের সমুদ্র রচনা করা হল; লাশের পর লাশ কেন পড়ে রইল রাস্তায়; লাশবাহী ট্রেনের পর ট্রেন কেন পাকিস্তান টু হিন্দুস্তান আর হিন্দুস্তান টু পাকিস্তান গেল?- এগুলো কি অহিংসা? তবে যে নেহেরুর নামে একটা শকুন হিন্দুস্তানের পক্ষাবলম্বী হয়ে গেল? তবে যে জিন্নাহর নামে এক শেয়াল পাকিস্তানের নামে উঠে পড়ে লাগল? তবে কেন মুকুলের মাকে দেশ ছাড়তে হল? তবে যে মন্মথ দারোগা তার কর্মস্থল ছেড়ে হিন্দুস্তানে চলে যাবার মনস্থির করল? তবে যে কুসমির কিশোর ছেলেকে জানের ভয়ে পাকিস্তান ছাড়তে হল? 
 সৈয়দ শামসুল হক এইসব সীমানা আর দেশভাগ, মানুষের রক্ত নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে অস্বীকার করতে চান আর তাই এর বিরোধিতায় উপন্যাসে একটা চরিত্র দাঁড় করান: মইনুল হোসেন মোক্তার; তাকে দিয়ে পুটকি মারতে চান গান্ধিকে; পুটকি মারতে চান জিন্নাকে; পুটকি মারতে চান নেহরুকে। তাদের পুটকিতে আছোঁলা বাঁশ দেয়ার জন্য নির্মাণ করেন একজন কিং ওয়াহেদকে, যে নিজে ঘোষণা দিয়ে বসে আলাদা রাষ্ট্রের। সৃষ্টি করেন একজন গোপালের মাকে, যে দেখে ওঠে হিন্দুরা পাকিস্তান ছাড়লে লাভ আর কারো নয় কেবল চোরদের; তারা চলে গেলেই চোরেরা পেয়ে যাবে ভা-ার লুটবার সুবিধা। 
১৯৪৭ সালের চৌদ্দই আগস্ট আধকোশা হিন্দুস্তানের ভাগে গেলে মইনুল হোসেন হাহাকার করে ওঠে “ওই যারা কাছারির মাঠে পাকিস্তানের নিশান নিয়ে নাচানাচি করছে, তাদের কি জানা নাই আধকোশা আর আমার দেশের নদী নয়? র‌্যাডক্লিফ সাহেবের লাল পেন্সিলের দাগে আধকোশা এখন হিন্দুস্তানের! আজ থেকে নদী তবে আর আমার নয়! এই আধকোশা এতকাল পরে তবে পর হয়ে গেল। এখন সে সীমান্তের ওপারে! আর সীমান্তই কাকে বলে? কোনো রেখা তো দৃষ্টিপথে নাই। আছে! র‌্যাডক্লিফ সাহেবের টেবিলে বিছানো বাংলার মানচিত্রের বুকে লাল পেন্সিলের দাগ! যেন রক্তধারা! রক্তের রেখার ওপারে এখন আধকোশা। ওপারের ওই বালি-বিস্তীর্ণ পাড় আর আমার নয়। ওপারের ওই ঝাউগাছ আমার নয়। ঝাউগাছের ভেতর দিয়ে বহে যাওয়া বাতাসও আর আমার নয়। বালির বুকে ওই ঘূর্ণিও আমার নয়। খেয়াঘাটের ওই বিরলে যে শনের ছাপড়ায় চা বানায় হাশমত, তার চুলার আগুনও আর আমার নয় তার গেলাশের চাও আর আমার নয়, তার ছাপড়ার আড়ে ঝুলানো মালভোগ কলার ছড়াও আমার নয়, ওই পায়ে চলা পথের চিহ্ন আর আমার নয়, ওই সরু পথটির উঠে যাওয়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে, তাও আর আমার নয়। আর আমার পায়ের তলায় তার ধূলি না লাগিবে হে! অন্য দ্যাশের ধূলি হয়া গেইছে আইজের ফজরে। ওপারের ওই আসমানও বুঝি পর হয়া গেইছে। সব মিছমার হয়া গেইছে গো। বুক ভাঙি নিয়া গেছে ঢলের আগেই এ কোন ঢল কোন পর্বত হতে নামিয়া!” এই হাহাকার কি উন্মাদনা? কেন হবে না এই হাহাকার? “কত আমাদের আরাম বিরাম আসা যাওয়া কত জাদু কত আঘাত কত বেদনা কত গান কত কনেদেখা কত বিবাহ কত জন্ম কত মৃত্যু এই নদী লয়ে” এই নদী পর হয়ে যাবে অথচ আমরা বুক চাপড়ে উঠব না তা কি করে হয়; আমরা তো শিমার হয়ে যায় নি। যদিও তিন দিন পরে নদী ফিরে আসে। কিন্তু সেই ফিরে আসাটাকে কি মেনে নেয়া যায়? এই যে নদীকে নারীর সাথে এত এত কবি সাহিত্যিক তুলনা করল, নদী যদি নারীর মতোই হবে; তবে কি তার অন্য পুরুষ গমনের পরও আমরা তাকে মেনে নেব? 
কেউ মূলত দেশ ত্যাগ করতে চায় না। কে চায় ছাড়তে নিজের মাতৃভূমিকে? নিজের বাপ দাদার ভিটাকে নিজের নাড়িপোতা দেশকে কে চায় পর করতে? তবু তারা দেশ ত্যাগ করল। কেন করল? তাদের তো অপশন দেওয়া হয়েছিলই? ফলত একটা জোশ সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অতল অন্ধকারে। “ সেই জোশ একেকজন একেক রকমে অনুভব করেছে, উত্তেজিত হয়েছে কেউ, কেউ ততটা হয় নাই, যারা হয়েছে তারা সেই ঝোঁকেই দেশ ছেড়ে পাকিস্তানের অজানা পথে পা বাড়িয়েছে” তারা সেই ঝোঁকেই দেশ ছেড়ে হিন্দুস্তানের দিকে পা বাড়িয়েছে, “ এবং অচিরকালে যখন সেই ঝোঁক কেটে গেছে, অচিরকালে যখন তারা বুঝতে পেরেছে ঝোঁকের বশে উত্তেজিত হয়ে কা-জ্ঞান হারিয়ে মানুষ যেমন খুন করে বসে, তেমনি তারাও বাপদাদার স্মৃতি খুন করে দেশ ছেড়েছে। আবার এমনও হয়েছে হিন্দু মুসলমানের বিবাদটা স্বার্থবাদীরা খুঁচিয়ে সৃষ্টি করেছে- নতুন পরিস্থিতিতে, দেশত্যাগের ফলে শূন্য মাঠে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরির ব্যাপক সুযোগ করে নেওয়ার জন্যে। আবার অনেকেই স্বপ্ন দেখেছে নতুন দেশে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বেহেশতি ভূমি- সুযোগের অবাধ প্রবাহ, অযোগ্যের জন্যে যোগ্যতারও অধিক সুযোগ।” 
এইখানে দাঁড়িয়ে তিনি ত্রিকালকে- ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল, আর বাংলাদেশের বর্তমান সময়কে- ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। দেশভাগের ব্যাপারে সহজ কথায় কিছুই বলা যায় না। প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনের পরে যখন ভারত স্বাধীন হল তখন দিল্লীর লোকেরা স্বাধীনতা বলতে থাকলেও পূর্ব বাংলা আর করাচির লোকেরা কিন্তু সেটাকে স্বাধীনতা বলতে পারল না। তারা সেটাকে দেশভাগ বা পার্টিশন বলে চালাতে থাকে। এই দেশভাগটা বড় নেতারা চাইলেই ঠেকাতে পারতেন। তাদের ভুলের কারণে, তাদের স্বার্থের জন্য সাধারণ মানুষেরা বলি হল। এইসব জটিলতার ভেতর বড় আশা নিয়ে প্রশ্ন করে চলেছেন লেখক, পাতার পর পাতায়- সে সময়টায় যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকতেন তবে কি বাংলা খ- হতে পারত? কাজী নজরুল ইসলাম যদি অসুস্থ না হয়ে পড়তেন তবে অত সহজেই বঙ্গভঙ্গ হতে পারত? 
দেশভাগের জাতীয় ইতিহাস যেমন উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে, তেমনি মানুষের ব্যক্তিগত ইতিহাসও ধরা পড়েছে। কেননা, জাতীয় ইতিহাস ব্যক্তিগত ইতিহাস সবই গুরুত্ব বহন করে। সময়টা যেমনই হোক; কিছু মৌলিক বিষয় থাকেই মানুষের জীবনে, যদি সে জীবিত থাকে: জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, সুখ, দুঃখ, শত্রুতা, বন্ধুত্ব, যৌনতা, অপরাধ, শুভ কাজ- এসবও সমান উপস্থিত থাকে মানব জীবনে; আছে এই উপন্যাসেও। এখানে ধর্মের অসারতার কথাও উঠে এসেছে। মূলত ধর্মটাই সকল অনিষ্টের মূল। এই ধর্মের কারণেই এত রক্তপাত এত খুনোখুনি। ধর্মকে কীভাবে পুঁজি করে বলরামপুরীরা জীবন পার করে দিচ্ছে সে কথাও আছে। মনিবের কথা যেমন আছে দাসের কথাও আছে। কথা আছে জনপ্রিয় লেখক চক্রের জনপ্রিয়তার আশ্রয়ে কোমলমতি তরুণীদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের কথা। কথা আছে পাখির, নদীর ও ফুলের।

দেশভাগ নিয়ে বর্তমান প্রজন্ম যা ভাবে: 

ভাবনা-১.
হিন্দু মুসলমানের ভিত্তিতে এই দেশভাগ মেনে না নেওয়া। 
ভাবনা-২.
মানা-না মানা আর এতদিন পর এ কথা বলা- অর্থহীন।
অভিযোগ এবং তার খ-ন
অভিযোগ-১.
সুব্রত কুমার দাস কি মফিদুল হক বা ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বা আরো অনেকের অভিযোগ নদী কারো নয় উপন্যাসটিতে পুনরাবৃত্তির ব্যাপারটা নিয়ে। একই শব্দ একই বাক্য একই প্যারা তিনি কেন ব্যবহার করলেন বারবার? আমরা যে সৈয়দ হককে চিনি, যে কি না অনর্থক একটা শব্দও ব্যবহারে ঘোর অবিশ^াসী, লেখায় সবচে বেশি সচেতন; সেই তার কোন রচনায়, তাও একদম পূর্ণ বয়সে, পুনরাবৃত্তি,- শব্দ বাক্য, এমনকি প্যারা- একবার দুবার নয়, পাঁচবার- কেন? এটা তো হতেই পারে না যে তিনি অসচেতনভাবে এটা করেছেন। তাহলে এর ব্যাখ্যা কী দাঁড়াবে? এটা এ কারণে হতে পারে যে বিষয়টার গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছেন তিনি। আবার প্রশ্ন জাগতে পারে যে গুরুত্ব বোঝাতে কোন একটা বিশেষ শব্দ ব্যবহার করলেই তো হয়ে যেত যে শব্দটা গুরুত্ব বোঝাবে এমন কোন শব্দ, তা না করে পুরো প্যারা কেন ব্যবহার করলেন তিনি? 
খ-ন:
সৈয়দ হকের পক্ষ থেকে আমরা উত্তর দিতে পারি; আমরা আমাদের নিজেদের জীবনের দিকে তাকালেই এর উত্তর পাব: কোন একটা স্পর্শকাতর দৃশ্য কিংবা ঘটনার সাথে যখন আমরা জড়িয়ে পড়ি, তখন সেই দৃশ্যটা কিন্তু পুরোপুরিই আসে, আমি কী বলেছিলাম, সে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল কীভাবে; এর প্রেক্ষিতে ঘটনা কোন দিকে মোড় নিয়েছিল আর তারপর কীভাবে হয়ে গেল একটা ভুল বোঝাবুঝি কিংবা অঘটন, যার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না; সেই কথাগুলো আমাদের করোটিতে একাধিকবারই প্রত্যক্ষ করে উঠব ঠিক তার সংলাপসহ- এই জিনিসটাই বোঝাতে চেয়েছেন বলে আমরা মনে করতে পারি। 
আমরা যারা ধর্মগ্রন্থ কোরান পড়ি এই বিষয়টা খেয়াল করে থাকব। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অবশ্য কোরানের শব্দ চয়নের বৈচিত্র্যে একঘেয়েমি কাজ করে না খুব একটা; কিন্তু সৈয়দ হকের ‘নদী কারো নয়’ পড়তে গিয়ে এই ধরণের পুনরাবৃত্তিতে যে বিরক্ত হবে না তা হলফ করে বলা শক্ত। 
অভিযোগ-২.
নদী কারো নয় উপন্যাসে দেখানো হয়েছে দেশভাগের ফলে পাকিস্তানের সুবিধাভোগী ধান্ধাবাজ দলের উল্লম্ফন: তারা কীভাবে হিন্দুদের ওপরে চড়াও হচ্ছে, বাধ্য করছে তাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে, তাদের পূজা অর্চনায় বাধা সৃষ্টি করছে কেমন করে আর তাদের পক্ষ নিচ্ছে যে সকল মুসলমান তাদেরকে কীভাবে কোণঠাসা করে ফেলছে। তখন প্রশ্ন জাগতে পারে ঠিক ওই একই সময়ে ভারতে মুসলমানরা হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে; তিনি যদি আধুুনিক লেখক হন আর যদি তিনি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকেই উপন্যাস লেখেন তাহলে সেই দৃশ্য কেন বর্ণনা করলেন না? 
খ-ন-১.
তিনি সেই দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। বলরামপুরীর বাবার কুচবিহার থেকে পাকিস্তানে প্রবেশ। 
খ-ন-২.
দেশ তো শুধু মাটি নয়। মায়ের মতো দেশ। জননী জন্মভূমি- লোকেই তো এমন বলে। জননীর মতো তার কোলে আশ্রয় পায়। ও মা, তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমরার  ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি! এ তো কেবল কবির কথা নয়, জ্যোাৎ¯œায় আপ্লুত রাতে গান গেয়ে ওঠা নয়! সেই দেশ যখন রাজনীতির কারণে দুভাগ হয়ে যায়- মাটি যে জননী- রক্ত তো পড়বেই। রক্ত পড়ে। সেই রক্ত হিন্দুর বুকে মুসলমানের ছুরিতে কি মুসলমানের গর্দানে হিন্দুর খাঁড়ার আঘাতে শুধু নয়, সে তো ছিল- মাটি থেকেই রক্তর ধারা দ্বিখ-িত মাটি-লাশ তেকে রক্ত পড়ে, রক্তে ভেসে যায় দেশ-মানুষের হৃদয়। কিন্তু শরীরের রক্তও মাটি ভেজায়- পাঞ্জাবে সেই সময়ের খোঁজ যারা রেখেছে তার জানে। পাঞ্জাবের সে কথা লিখবেন খুশবন্ত সিং লিখবেন ভীষ্ম সাহানি, আর কৃষণ চন্দর আর সাদাহ হোসেন মান্টো।  

যদিও জানা, তবু অজানা

জীবন: বেয়াড়া বলদ- কখন কোনদিকে ধাবমান হবে তার ঠিক নাই, তার নিয়ন্ত্রণটাও সব সময় হাতে থাকে না। 
প্রেম: নদীর মতো। বইছে তো বইছেই। ঢল নামছে তো ফুলে উঠছে। কূল ছাপিয়ে কলকল করে ছুটছে। আবার গগন ধাওয়ানো তাপ রোদ্দুর বিমৌসুম তো নদী শুকিয়ে নালাটি তখন। ছাগলেও খুরখুরে পায়ে পার হয়ে যায় অক্লেশে। 
মৃত্যু: আমাদে সময়-ধারণাকে গিলে খায়। এই ছিল, এই নাই! এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছু নাই, মানুষ তবু চমকিত হয় মৃত্যু যখন তার কালো চাদরে আমাদের বোধশক্তিকে অকস্মাৎ আচ্ছাদিত করে। 
পাপ-পূণ্য:  পাপ-পূণ্য যাকে বলে, সেই পাপ করতে মানুষ এত সুখ পায় কেন? সুখ যাতে পাওয়া যায়, যা করলে সুখের ঢলে মন ভরে যায়, পাপ সেটা কী করে হয়! সুখই যদি মানুষের চাওয়া হয়, পাপ করেই যদি সুখ পাওয়া যায়, তবে সেই পাপ করলে পাপ কিসে হয়?
সাহিত্য: সাহিত্য তো তাই যা হলেও হতে পারত, এবং হলে এই রকমটিই হতো, আর অন্য কোন রকম নয়।
আঙ্গিক-ভাবনা: এক রঙ অনেকক্ষণ, তারপর অপর রঙে। গল্পের বুনোন এক রঙে হতে হতে অপর রঙে এসে পড়ে। কেন এক রঙে শেলাই করতে করতে অপর রঙের সুতো সুঁইয়ের ছিদ্রে পরিয়ে নিতে সাধ হয় কাঁথার রমণীরা স্পষ্ট করে জানে না। কিন্তু আমরা জানি। ক্লান্তি নয়, অবসাদ নয়, কল্পনাই তাদের তাড়না করে। 
জনপ্রিয়তা: বাজে নকশায় তৈরি বাড়ি। 
দূরত্ব ও অপরিচয়: হিন্দু মুসলমানের মানসিক দূরত্ব, সামাজিক অপরিচয়, অশ্রদ্ধা- হিন্দুর প্রতি মুসলমানের নয়, মুসলমানের প্রতি হিন্দু উচ্চবর্ণ এবং শিক্ষিত সমাজের।
মানব সভ্যতা: পৃথিবীতে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা অধিক, গরিবের সংখ্যা ততধিক, বলতে গেলে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এরাই মানবের আসল রূপনির্মাতা এবং শেষ পর্যন্ত এই প্রলেতারিয়েতরাই সভ্যতার ভাগ্যনিয়ন্তা।
মন: ভেতরের সব শক্তি দিয়ে শূন্যের ভেতরে সত্য ছবি তৈরি করতে চাওয়া, এমন ছবি যা হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়।
বৈষম্য: বাঙালি মুসলমান কখনোই হিন্দু ও হিন্দুর জীবনকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখে নাই, কিন্তু হিন্দুরা দেখেছে, সেই হিন্দুরা যারা বর্ণ এবং ধনসম্পদে উচ্চ শ্রেণির, যারা মতামতের নেতৃত্বে। 
অথবা
কলকাতার এত ভালো ভালো কথা ও বড় বড় বুদ্ধিজীবীদের এত বিশ^ দর্শন সত্ত্বেও ঘরের বাইরে ঘাসের শীষের ওপর শিশির বিন্দুটি তারা দেখে নাই, ফলত বাঙালি মুসলিম সমাজের কথা জানবার কোনো আগ্রহ এতদিনেও বাঙালি হিন্দুজন কি পাঠকের মধ্যে মোটে গড়ে ওঠে নাই। 
অথবা
হিন্দু মুসলমানেরা এত শতাব্দী পাশাপাশি বাস করে, আরো অধিক- হাটে বাজারে খেতে মাঠে মাছ ধরার নদীতে একই জীবন কি যৌথ জীবনই যাপন করেও, পরস্পরের থেকে কতটাই না দূরে। এবং এই দূরত্বটি মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুজনের বোধেই ও তাদের সামাজিক জীবনে উপস্থিত প্রায় সর্বাংশেই। 
অথবা
বাঙালি মুসলিম সমাজে আত্মীয়স্বজনের সম্পর্কসূচক সম্বোধনের শব্দগুলো- ভাবি, খালা, ফুপু, খালুজান, ফুপাসাহেব; বিপরীতে বৌদি, মাসি, পিসি, মেসোমশাই, পিসেমশাই! মুসলমানরা যদিও মাসি পিসি বোঝে, বোঝে যে কাকে সম্বোধন করা হচ্ছে, বক্তার সঙ্গে উদ্দিষ্টের সম্পর্কটা কী, কিন্তু আমরা দেখব হিন্দুজনেরা খালা ফুপু একেবারেই বুঝতে পারছে না। ভাইকে দাদা ডাকার চল হিন্দু মুসলমান সবার ভেতরে। মুসলমান অনেকেই হিন্দুজনের মাতৃসমান নারীকে খালার বদলে মাসি বলে ডাক দেয়, ফুপুর বদলে ডাক দেয় পিসি; বিপরীতে এই সৌজন্যটি কিন্তু কোন হিন্দুর কণ্ঠে শোনা যায় নাই যে খালা বলে মায়ের সমান মুসলমান নারীকে ডাকছে।
সাযুজ্য: রোগীর কোন হিন্দু মুসলমান নাই।
অথবা
 ভাষারও কোন হিন্দু মুসলমান নাই।
অথবা
গরীব ও খেটে খাওয়া মানুষের স্তরে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ভেতরে হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কোন বিরোধ বা অশ্রদ্ধা নেই। 
অথবা
হিন্দু এবং মুসলমান এক সুন্দরী নারীর দুটি চোখের মতো। কোনো আঘাতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেলে অপরটিও নষ্ঠ হয়ে যায়।

অথবা

এও সত্য, ওও সত্য, কিংবা সত্যমিথ্যার কথা নয়, দুইই আছে পাশাপাশি, যেমন দুই প্রতিবেশী, অধিক কি- বিবাদ যদি লাগে তবে তা দুই সতিনের মতো মাঝে মাঝে, তখন সতিনও যেমন সত্য, তাদের বিবাদও সত্য, এক শরীরের নিচেই দুইয়ের শয়ান!
নিরপেক্ষতা: মানুষকে তো আমরা আমাদেরই পরকলা পরা চোখের ভেতর দিয়ে দেখি। আমরা যদি উন্মাদ তো জগৎ উন্মাদ দেখি। আমরা যদি তস্কর, তবে জগতের সকলেই তস্কর। সাধু তো সাধু। 
সীমান্ত: সবের চেয়ে বড় আচ্চয্য বডার। এক মাটি, এক হাওয়া বাদল, এক নদী, এক আকাশ, এক ভাষা, একই মইষালের গীত গীদাল, কিন্তু বডার। না এসপার না ওসপার। খবোদ্দার।

অথবা

একই ধুলোমাটি। একই ঘাস। ঘাস চিরে দাগ পড়ে গেছে। মানুষের পায়ে পায়ে। ফিতের মতো বিছিয়ে আছে। কোথায় এর ছিন্নতা! ওই! ওই তো! হাঁটুসমান উঁচু পিলার। ছোট্ট পিরামিড যেন। খেলনার পিরামিড। মাথাটা ভোঁতা। ওপরে লোহার চাকতি বসানো। চাকতির ওপরটা যোগচিহ্নের মতো অগভীর রেখায় খোদিত। যোগচিহ্নের খাড়া মাথায় লেখা ইন্ডিয়া, নিচের দিকে পাকিস্তান। আর যোগচিহ্নটার ভূমি-সমান্তরাল খাদে সুতো ধরে পরের পিলারে টেনে ধরলেই হয়ে গেল সীমান্তরেখা। নিষেধের অদৃশ্য বেড়া। নিষেধ! অপর দেশ!
ইতিহাস: কখনো কখনো সর্প হয়ে আমাদের দংশায়। কলার মান্দাসে তখন আমাদের লাশ নদী দিয়ে যাত্রা করে, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে যায়, কালের পর কাল, যদি কেউ সর্পাঘাতে নীল হয়ে যাওয়া শবটিকে জীবন ফিরে দেয়। আলো স্তিমিত হয়ে যায়।

গল্পটা এমন হলেও হতে পারত

কেমন হত যদি সৈয়দ শামসুল হকের পথ চলা শেষ না হত! শেষ তো হতই, কথা হচ্ছে, উপন্যাসটা যদি তার জীবদ্দশায় শেষ হত, তবে এর রূপটা কেমন হত?
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেন কি তার বাবার মৃত্যু-রহস্যের কিনারা করতে পারত? নাকি সে নিজেই মারা যেত? কেননা প্রথম বাক্যেই আমরা খেয়াল করে থাকব মকবুল হোসেনের যাত্রাকে অযাত্রা বা অলুক্ষণে বলার চেষ্টা করা হয়েছে; তবে কি সে মারা যাবে, আর মারাই যদি যাবে তাহলে আবার কেন বলা হল তার মেয়ে প্রিয়লি একদিন ফিরে আসবে এবং তার সাথে গল্প করবে? সাইদুর রহমান কন্ট্রাকটর কি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করত কুসমিকে- ধর্মান্তর করিয়ে- সম্পত্তি দখল করে নিতে? মন্মথ দারোগা কি চলে যেত হিন্দুস্তানে মিথ্যা আশায়? কিং ওয়াহেদের কী খবর? সে যে নিজেকে রাজা ঘোষণা করে বসল, তার সেই রাজত্ব কতদিন টিকে ছিল? মুকুলের মা এখন কোথায়?
এসব নিয়ে আমরা কল্পনা করতে পারি; যদিও কল্পনা বলতে কিছু নেই- শিমুল মাহমুদের ভাষায়- সে বাস্তবতার অন্যরূপ; তাই বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আমরা কল্পনা করে নেব মকবুল হোসেন তার বাবার মৃত্যুরহস্যের সমাধান পাবে না; কেননা, তার ভেতর যে উন্মাদনার উন্মেষ- হ্যাঁ উন্মেষ- দেখা দিয়েছিল যা তাকে আর সবার থেকে আলাদা করে দেয় সেটাই তাকে শেষ করে দেয় একদিন: মইনুল হোসেনকে আমরা মৃত আবিষ্কার করি আধকোশা নদীতে; কেননা মইনুল হোসেন মোক্তারদের আসলে বেঁচে রাখে না ইতিহাস; তাদের মেরে না ফেললে ইতিহাসের বজ্জাতি প্রকাশ হয়ে পড়বে। কুসমিকে সাইদুর রহমান জোর খাটিয়ে ধর্মান্তর করবে আর তারপর বিয়ে;- দিকে দিকে চলে গেছে, যেমন যাচ্ছে, যেমন যাবে- নষ্টদের অধিকারে। মন্মথ দারোগা চলে যাবে যেরকম অলীক বিশ^াসে এপার এসেছিল বলরামপুরীর বাবা; হাকীম নেয়ামতুল্লাহর মতো কাদিয়ানি লোকেদের অবস্থা কী হত, যারা না মুসলমান, না হিন্দু?
 নজির মিয়া? মজিবর রহমান? নজির মিয়া আর মজিবর রহমানরা সংখ্যালঘুদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করবে, লুটে নিবে ওদের সব; তারপর বেঁচে থাকবে শুধু মজিবর রহমানরা। তাদেরই রাজত্ব কায়েম হয়ে যাবে অতঃপর। এরপর শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার; তারপর একদিন এইসব অন্ধকার বিষয়ক জটিলতার অবসান ঘটিয়ে দেশে উড়বে লাল সবুজের পতাকা; কিন্তু সেই পতাকাকেও খামচে ধরতে দেখা যাবে পুরনো কতক শকুনকে; আর আমরা আপামর জনতা এইসব নিরেট বাস্তবতাকে মনে করব স্বপ্নবাস্তবতা- একদিন এই অন্ধকার ছিন্ন করে বেরিয়ে আসবে আলো; আমরা সেই আলোয় ভাসতে ভাসতে হাবুডুবু খেতে খেতে পিছন ফিরে চাইব: হ্যাঁ ছিল একটা সময়; তারপর আবার সেই স্বপ্ন কল্পনা করতে করতেই ইতিহাস আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে আরেক স্বৈরাচার শাসককে; আমরা সেই শাসকের স্বৈচারিতায় নিমগ্ন হব আকণ্ঠ; বঞ্চনায় পরাধীনতায় পাছা চুনের খুটি হয়ে গেলেও পুরোহিত বামন সেজে অথবা কাঠখোট্টা মৌলবি হয়ে জপ করতে থাকব: সাধু সাধু; অথবা: সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ।

No comments:

Powered by Blogger.