Breaking News
recent

জ্যামিতি অংশে দুর্বলতা?

জ্যামিতি অংশে দুর্বলতা?

“জ্যামিতি আবার বোঝার কী আছে?” কিংবা “উপপাদ্যগুলো টানা মুখস্থ করে ফেলি”- দুর্ভাগ্যবশত এই ধরণের চিন্তা ভাবনা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায়ই করে থাকে। আর গণিত পরীক্ষার সময় উপপাদ্য প্রমাণ করা কিংবা সম্পাদ্যের বিদঘুটে চিত্র আঁকা অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নের মতন। আমি আমার পরিচিত অনেককেই দেখেছি শুধু জ্যামিতির জন্যে তারা গণিতকে ভয় পায়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে গণিত কিংবা জ্যামিতি কোনোটাই ভয় পাওয়ার মতন কিছু না। আর জ্যামিতি অংশে ভালো করার জন্যে তোমাকে পিথাগোরাসের মতন মহা পন্ডিত হতে হবে এমন না, বোর্ডের বই আর সামান্য ইচ্ছাই যথেষ্ট।

মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক উভয় ক্ষেত্রে জ্যামিতি পাঠ্যক্রমে থাকলেও তাদের ধরন আসলে ভিন্ন রকম। মাধ্যমিক স্তরের জ্যামিতি যেখানে উপপাদ্য, সম্পাদ্য অথবা পরিমিতির অংকের মাঝে সীমাবদ্ধ সেখানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জ্যামিতি আরও বেশি প্রয়োগমূলক এবং স্থানাংক ভিত্তিক। তাই মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জ্যামিতি অংশের ভীতি কাটানোর জন্যে আলাদা করে পরামর্শ উপস্থাপন করছি। 

জ্যামিতি অংশ (নবম-দশম শ্রেণি)

১) আকৃতিগুলোর সম্পর্কে মৌলিক ধারণা বৃদ্ধি করো

তুমি যদি একটু খেয়াল করে দেখো, তোমার পাঠ্যবইয়ের জ্যামিতি অংশের সব কথাবার্তা কিন্তু ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্তের সাথে অন্যান্য কিছু পরিচিত আকৃতি নিয়েই। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় আমরা এই আকৃতিগুলোর সংজ্ঞাপ্রকারভেদবৈশিষ্ট্য এবং ধর্মগুলো সম্পর্কে খুব বেশি না জেনেই বড় উপপাদ্য প্রমাণের কাজে লেগে পড়ি। অনেকেই প্রশ্ন করে বসতে পারো, “এগুলো জেনে কী হবে? পরীক্ষায় তো সরাসরি সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য কিংবা ধর্ম জিজ্ঞেস করা হয় না।”
এই প্রশ্নের উত্তরে একটা উদাহরণ দেয়া যাক, যদি তুমি একটা দেয়াল তৈরি করতে চাও তাহলে তোমার ইট, বালি,সিমেন্টের প্রয়োজন হবে। আবার যদি একটা দালান বানাতে চাও, তাহলে অনেকগুলো দেয়াল, পিলার, ছাদ দিয়েই তৈরি হবে দালান। একটা উপপাদ্য প্রমাণ করা কোনো অংশেই দেয়াল কিংবা দালান তৈরির থেকে কম না। আকৃতিগুলোর সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং ধর্ম দিয়েই ধাপে ধাপে প্রমাণ করা হবে একটা উপপাদ্য। তাই এইসব আকৃতিগুলো সম্পর্কে মৌলিক ধারণা রাখা অত্যন্ত জরুরি। মৌলিক বিষয়গুলোর কিছু উদাহরণ হলো:
  • ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ডিগ্রী।
  • চতুর্ভুজের চার কোণের সমষ্টি ৩৬০ডিগ্রী।
  • ত্রিভুজের একটি বাহুকে বর্ধিত করলে যে বহিঃস্থ কোণ উৎপন্ন হয়, তা এর বিপরীত অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের সমষ্টির সমান।
  • ত্রিভুজের একটি বাহুকে বর্ধিত করলে যে বহিঃস্থ কোণ উৎপন্ন হয়, তা এর বিপরীত অন্তঃস্থ কোণ দু’টির প্রত্যেকটির থেকে বড়।
  • সমকোণী ত্রিভুজের সূক্ষকোণদ্বয় পরস্পর পূরক।
  • বৃত্তে অন্তর্লিখিত সামান্তরিক একটি আয়তক্ষেত্র।
  • বৃত্তের কোন বিন্দুতে একটিমাত্র স্পর্শক আঁকা সম্ভব।
  • বৃত্তের বহিঃস্থ কোনো বিন্দু থেকে ঐ বৃত্তে কেবল দুইটি স্পর্শক আঁকা যায়।
তোমাদের পাঠ্যবই থেকেই উদাহরণগুলো সংগ্রহ করেছি। আর এমন সব মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনীর আগে লেখা কথাবার্তাগুলো পড়ো বেশি বেশি।

২) কোণের সম্পর্কে ধারণা বাড়াও

বইয়ের পাতায় বিদঘুটে সম্পাদ্যের চিত্রের নিচে যে “অংকনের বিবরণ” লেখা থাকে সেখানে মাঝে মাঝেই দেখবে হঠাৎ সূক্ষ্মকোণ কিংবা স্থূলকোণ আঁকা হয়। আবার উপপাদ্যের প্রমাণেও দেখা যায় “তারা পরস্পর বিপ্রতীপ কোণ” কিংবা “তারা পরস্পর সম্পূরক কোণ”-এই ধরণের লেখা। এখন তুমি যদি সূক্ষ্মকোণ আর স্থূলকোণ কীভাবে আঁকতে হয় তা না জানো অথবা বিপ্রতীপ কোণ আর সম্পূরক কোণ কখন হয় তা না জানো, তাহলে তোমার জন্যে সম্পাদ্য আঁকা কিংবা উপপাদ্য প্রমাণ করা উভয়ই প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আকৃতির মতন কোণ সম্পর্কেও বিস্তারিত ধারণা থাকা চাই।
সন্নিহিত কোণ, সমকোণ, স্থূলকোণ, সূক্ষ্মকোণ, প্রবৃদ্ধ কোণ, সরল কোণ, সম্পূরক কোণ, পূরক কোণ, বিপ্রতীপ কোণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কোণ সহ সকল কোণ সম্পর্কে মৌলিক ধারণা নেওয়া এবং তাদেরকে আঁকতে শেখা উপপাদ্য প্রমাণ কিংবা সম্পাদ্য আঁকার জন্যে অত্যন্ত জরুরি। পাঠ্যবই এর পাতায় পেয়ে যাবে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্য।

৩) কঠিন টার্মগুলো সম্পর্কে জানো

সত্যি কথা বলতে বইয়ের পাতায় উপপাদ্যের প্রমাণ কিংবা সম্পাদ্যের অংকনের বিবরণ অনেক কঠিন ভাষাতে উপস্থাপন করা হয়। তার সাথে জ্যামিতির কিছু কিছু কঠিন টার্ম বিষয়টাকে আরও বেশি ভীতিকর বানিয়ে ফেলে। কিন্তু এই কঠিন শব্দগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করলে আসলে সম্পূর্ণ বিষয়টাকে সহজেই আয়ত্বে আনা যায়।
যেমন ধরা যাক সর্বসমতা। দুইটি ত্রিভুজ কখন সর্বসম হয়? যখন দুইটি ত্রিভুজের তিন কোণ এবং তিন বাহু পরস্পরের সমান হয় তখন বলা হয় ত্রিভুজ দুইটি সর্বসম। এই রকম অসংখ্য টার্ম জ্যামিতিতে ব্যবহার করা হয়। আগে থেকেই এ সকল টার্ম সম্পর্কে ধারণা থাকলে উপপাদ্য প্রমাণে সমস্যা হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
সম্পাদ্য আঁকার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু টার্ম থাকে। যেমন, বাহুর সমদ্বিখণ্ডক কিংবা কোণের সমদ্বিখণ্ডক, বৃত্তের ক্ষেত্রে বৃত্তচাপ নেয়া, কম্পাসের সাহায্যে লম্ব আঁকা ইত্যাদি ছোটখাটো বিষয়গুলো আগে থেকে দেখে রাখলে সম্পাদ্য আকাঁর সময় আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।

৪) মুখস্থকে না বলো

শুরুতেই বলেছি, জ্যামিতি কিংবা গণিত কোনোটিই ভয় পাওয়ার কিংবা মুখস্থ করার বিষয় না। আমার তো মনে হয় না বইয়ের পাতায় থাকা পঞ্চাশটার বেশি উপপাদ্যের প্রমাণ এবং তার প্রায় সমপরিমাণ সম্পাদ্যের অংকনের বিবরণ কারো পক্ষে মুখস্থ করা আসলেই সম্ভব। এই গুরুগম্ভীর লেখাতেও তোমাদের একটা চমৎকার ঘটনা বলি যা তোমাদের মুখস্থ না করার উপকার সম্পর্কে ধারণা বাড়াবে।
স্কুলে আমার বেশকিছু গণিতপ্রেমি বন্ধু ছিলো যারা কিনা গণিত মুখস্থ না করে মৌলিক বিষয় গুলোকে বোঝার এবং নিজের আয়ত্বে আনার চেষ্টা করতো সবসময়। তাদের সব থেকে অসাধারণ কাজ ছিলো বইয়ের উপপাদ্যগুলো কীভাবে ভিন্ন এবং যুক্তিসংগতভাবে প্রমাণ করা যায়। একবার পরীক্ষার হলে তাদের মধ্যে একজন একটা বড় উপপাদ্যকে খুব অল্প কথায় যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে। কিন্তু শিক্ষক প্রথমে তাকে কোনো নম্বর দেননি। পরবর্তীতে শিক্ষকের কাছে আপিল করলে তিনি অবাক হয়ে তাকে পূর্ণ নম্বর দিয়েছিলেন। মুখস্থ না করে জ্যামিতির মৌলিক ধারণা বৃদ্ধি করার মাধ্যমেই জ্যামিতিতে ভালো করা সম্ভব।
যখন তুমি উপপাদ্যের পেছনের কথাগুলো সম্পর্কে জানবে তখন তোমার কাছে তা প্রমাণ করা খুব কষ্টের কিছু মনে হবে না। তখন দেখবে একটু চেষ্টা করলেই তা প্রমাণ করা যাচ্ছে মুখস্থ করার কোনো প্রয়োজনই পড়ছে না।

৫) পরিমিতি ও ঘন জ্যামিতির ক্ষেত্রে করণীয়

পরিমিতি ও ঘন জ্যামিতি অনেকটাই প্রমাণ এবং অঙ্কন ভিত্তিক জ্যামিতি থেকে আলাদা। এখানে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ,বৃত্ত এসব আকৃতি তার সাথে বিভিন্ন ত্রিমাত্রিক আকৃতি যেমন, সিলিন্ডার, গোলক, প্রিজম ইত্যাদি দিয়েই ক্ষেত্রফল, আয়তন, পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়।
সবার আগে সূত্রগুলোর প্রমাণসহ ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করে নিজের আয়ত্বে আনতে হবে। কীভাবে সূত্রগুলো প্রয়োগ করতে হয় তা শিখে নিতে হবে, তার সাথে বিভিন্ন টাইপ ভিত্তিক অংক বই থেকে প্র‍্যাক্টিস করে যেতে হবে। তাহলেই পরিমিতি এবং ঘন জ্যামিতি অংশে ভালো করা সম্ভব।

জ্যামিতি অংশ (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি)

১) স্থানাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা বাড়ানো

মাধ্যমিক স্তরের ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত নিয়েই উচ্চ মাধ্যমিকে কাজ করা হয় কিন্তু ভিন্ন ভাবে৷ এখানে উপপাদ্য প্রমাণ কিংবা সম্পাদ্য অংকনের প্রয়োজন না থাকলেও সেই পুরনো উপপাদ্যগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজে আসে। কিন্তু এখানে অংক করা লাগে প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং সকল হিসাব করা হয়ে থাকে স্থানাংক পদ্ধতিতে। তৈরি করতে হয় নানা ধরণের সমীকরণ।
সরলরেখার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন বিন্দুগামী সরলরেখার সমীকরণ নির্নয়, সরলরেখার মধ্যমা নির্নয়, বিভিন্ন বিন্দু থেকে সরলরেখার দূরত্ব নির্ণয় ইত্যাদি এবং বৃত্তের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন বিন্দু ও সরলরেখা স্পর্শ করে তৈরি করা বৃত্তের সমীকরণ নির্ণয় করতে হয় সাথে আরও অনেক কিছু। এই সব ক্যাল্কুলেশন মূলত করা হয় স্থানাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে। বিভিন্ন বিন্দু এবং চতুর্ভাগের হিসাব করার ধারণা বৃদ্ধি করতে হবে।

২) থিওরিতে গুরুত্ব প্রদান করা

উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে জ্যামিতি অংশে যার থিওরি সম্পর্কে ধারণা যতো পরিষ্কার থাকবে তার পক্ষে ততো বেশি ভালো করা সম্ভব। সরলরেখা, বৃত্ত, কনিক-এর গুরুত্বপূর্ণ থিওরিগুলো অনুশীলনীর অংক ধরার আগেই পড়ে নিতে হবে। সাথে সূত্রগুলোর শেকড় থেকে ডালপালা সব কিছু সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন শর্ত রয়েছে যেগুলো হরহামেশাই অংক করার সময় কাজে আসে, এগুলোকে কখনোই এড়িয়ে চলা উচিত না।

৩) মোবাইল ফোনে গ্রাফিং ক্যালকুলেটর ব্যবহার

যেহেতু উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জ্যামিতিগুলোকে গ্রাফের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় এবং পরীক্ষার হলেও গ্রাফের মাধ্যমেই সৃজনশীল প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়, তাই মোবাইল ফোনে গ্রাফিং ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা হতে পারে একটি অসাধারণ সমাধান! DESMOS নামে একটি ফ্রী গ্রাফিং ক্যালকুলেটর গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় যা অসম্ভব কার্যকর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জ্যামিতিতে আশানুরূপ ফল অর্জনের জন্য।
অ্যাপটি ডাউনলোড করতে ক্লিক কর : [ https://play.google.com/store/apps/details?id=com.desmos.calculator ]
সবশেষে যে কাজটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো অনুশীলন। তুমি অনেক ভালো জ্যামিতি বুঝলেও অনেক দিন প্র‍্যাক্টিসের বাহিরে থাকলে আসলে তোমার টার্মগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে। অন্যদিকে তুমি যদি খুব ভালো জ্যামিতি নাও পারো, প্রতিদিন চেষ্টা করতে করতেই একটা ভালো পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে নিজেকে। জ্যামিতি ভয় পেয়ে এড়িয়ে গেলে কিংবা বোকার মতন মুখস্থ করে দিন শেষে কোন ফলাফল পাওয়া যাবে না। তাই চর্চা করতে থাকো, নিজেই বুঝে যাবে জ্যামিতি জিনিসটা আসলেই কতো মজার!

No comments:

Powered by Blogger.